খাদ্যনালীর ক্যান্সার
খাদ্যনালীর ক্যান্সার কি?
খাদ্যনালীর ক্যান্সার হল একধরনের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যা প্যারাপ্লাজম এর মাধ্যমে অন্ননালীর যে কোন অংশে অথবা পরিপাকতন্ত্রে হয়ে থাকে এবং পরবর্তী পর্যায়ে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
খাদ্যনালীর ক্যান্সারকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। সবচেয়ে বেশী যে ধরনটি দেখা যায় তা হল স্কোয়ামাস সেল যার হার ৯০% এরও বেশী এবং এটির মেটাস্টাসিস প্রসেস দীর্ঘস্থায়ী হয় যে কারণে প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করা গেলে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি প্রভৃতির মাধ্যমে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। অন্য ধরণগুলো খুব কমই দেখা যায় যেমন এসোফ্যাগাস এর এডিনোকার্সিনোমা , স্মল সেল আনডিফারেনশিয়েটেড কার্সিনোমা ও কারসিনোকার্সিনোমা। এগুলোর প্রভাব অত্যন্ত প্রকট হয়ে থাকে।
প্রতি বছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ এই ক্যান্সারে মারা যান যার মধ্যে বেশিরভাগই পুরুষ। পুরুষ এবং মহিলা ভেদে এই মৃত্যুর হার ১ঃ১ থেকে ১৭ঃ১। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পর এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হল ৬০-৬৯। প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা মাত্রই খুব বেশী দুশ্চিন্তাগ্রস্থ না হয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে। কারণ আগে থেকে ট্রিটমেন্ট শুরু করা গেলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
কি কারণে এই ক্যান্সার হয়?
বিভিন্ন কারণে এই ক্যান্সার হতে পারে যেমন শারীরিক অবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, বংশগত কারণ ইত্যাদি তবে প্রধানত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন পদ্ধতি এর জন্য দায়ী।
এই ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি কি?
খাদ্যনালীর ক্যান্সারের প্রথমিক লক্ষণগুলো স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ডায়াগনোসিস করার সময় এই ক্যান্সার বেশী ছড়ায় এবং সার্জারি করার পর বেঁচে থাকার হার ২৫%৪০%। সুতরাং ক্যান্সারের লক্ষণগুলো সম্পর্কে আগে থেকে জানা থাকলে এবং প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহন করা গেলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
এই ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণগুলো হলঃ
১. গলধঃকরনের সময় বুকে জ্বালা পোড়া বা সূচের মত কোন কিছু অনুভূত হওয়া।
৩.খাবার খেতে প্রচণ্ড অসুবিধা হওয়া এবং সাথে বমি হওয়া, পেটে ব্যথা করা বা ওজন অতিমাত্রায় হ্রাস পাওয়া।
৪. খাবার খেতে অসুবিধা হওয়ার ফলে পুষ্টিহীনতা দেখা যায় এবং শরীর অত্যন্ত শুকিয়ে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণত পর্যায়ে কিছু জটিলতা যেমন মেটাস্টাসিস বা অসহনীয় ব্যাথা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
উল্লেখ্য যে উপরের লক্ষণগুলো শুধু খাদ্যনালীর ক্যান্সারকেই নির্দেশ করে না, অন্য রোগও নির্দেশ করতে পারে। সুতরাং যাই হোক না কেন এই লক্ষণগুলো দেখা মাত্রই দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
খাদ্যনালীর ক্যান্সার নির্ণয়ের বিভিন্ন পরিক্ষাঃ
১. ফাইবারেন্ডস্কপিঃ এই পরীক্ষাটি হজম তন্ত্রের রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
২. ডাইজেসটিভ ট্র্যাক্ট এন্ডসকোপিক আলট্রাসনোগ্রাফিঃ এটির সাহায্যে খাদ্যনালীর প্রাচীরে কোন ক্ষত থাকলে তা সনাক্ত করা যায়। লসিকাগ্রন্থি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলে তাও সনাক্ত করা যায় এবং খাদ্যনালীর প্রাচীরে ঠিক কোন স্থানে ক্ষত আছে তাও জানা যায়।
৩. এক্সরে ব্যারিয়াম মিল পরিক্ষাঃ এটির সাহায্যে ক্ষত স্থানের আকৃতি ও অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় এবং কোন ক্যান্সার সেল আছে কিনা তাও জানা যায়।
৪. সি.টি.ঃ এটি ক্যান্সার নির্ণয় করতে না পারলেও খাদ্যনালী এবং এর সংলগ্ন মেডিয়েসটিনাম এর সম্পর্ক নির্ণয়ে সাহায্য করে। তবে সি.টি. স্ক্যান এর সাথে এক্সরে করা হলে তা ক্যান্সার ও এর পর্যায় নির্ণয়ে সাহায্য করে।
৫. এসোফ্যারিঙ্গিয়াল এক্সফ্লয়টেটিভ সাইটোলজি এক্সামিনেশন ঃ সহজ সুবিধাজনক এবং স্বল্পব্যথা বিশিষ্ট এই থেরাপি খাদ্যনালীর ক্যান্সার দ্রুত নির্ণয়ের জন্য একটি প্রধান পরীক্ষা।
খাদ্যনালীর ক্যান্সারের বিভিন্ন পর্যায় ঃ
স্টেজ ০ঃ এই পর্যায়ের ক্যান্সারকে প্রাথমিক পর্যায়ের খাদ্যনালীর ক্যান্সারও বলা হয়। এই পর্যায়ে ক্যান্সার কোষ অন্যান্য কোষের সাথে স্বাভাবিক অবস্থায় খাদ্যনালীর বহিঃত্বকে অবস্থান করে কোন ধরনের ম্যালিগন্যান্ট ছাড়াই।
স্টেজ ১ঃ এই পর্যায়ে ম্যালিগন্যান্ট কোষ বা ক্যান্সার কোষ বহিঃত্বক ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর নিম্নস্ত স্তরে পৌছায় কিন্তু পেশীর স্তর তখনও ভেদ করে না। এই পর্যায়ে ক্যান্সার কোষ লসিকাগ্রন্থি বা অন্য কোন প্রত্যঙ্গে ছড়ায় না।
স্টেজ ২ঃ এই পর্যায়ে ক্যান্সার লসিকা গ্রন্থিতে প্রবেশ করে কিন্তু অন্য কোন প্রত্যঙ্গে ছড়ায় না।
স্টেজ ৩ঃ এই পর্যায়ে ক্যান্সার খাদ্যনালী সংলগ্ন শ্বাসনালীতে আক্রমণ করে কিন্তু এর সংলগ্ন লসিকা গ্রন্থি সুরক্ষিত থাকে এবং আশেপাশে তখনও ক্যান্সার ছড়ায় না।
স্টেজ ৮ঃ এই পর্যায়ে ক্যান্সার রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে হাড়, লিভার এমনকি মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়ে।
খাদ্যনালীর ক্যান্সারের চিকিৎসা কি?
ক্যান্সারটি ঠিক কোন পর্যায়ে আছে তার উপর এর চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ভর করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ক্যান্সার সনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রন করে রোগীর জীবনকাল বাড়ানো সম্ভব। ক্যান্সার পরিণত পর্যায়ে চলে গেলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে শুধুমাত্র ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তি রোধ করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব। রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে একাধিক বা সম্মিলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়।
১. সার্জারিঃ সার্জারির মাধ্যমে টিউমার এবং এর সংলগ্ন লসিকা গ্রন্থি অপসারন করা হয়। ক্যান্সার প্রথমিক পর্যায়ে থাকতে সার্জারির মাধ্যমে অনেক ভাল ফল পাওয়া যায়। সঠিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতির মাধ্যমে ক্যান্সার কোন পর্যায়ে আছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা গেলে কার্যকর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। স্টেজ ১ এর রোগীদের ক্ষেত্রে সার্জারির পর অতিরিক্ত ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮০%-৯০% পর্যন্ত থাকে। অন্যদিকে যারা পরিণত পর্যায়ে অর্থাৎ স্টেজ ৩ বা ৪ এ তাদের ক্ষেত্রে সার্জারির পর অতিরিক্ত ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ১৫%।
২.রেডিওথেরাপিঃ এটি সার্জারির পূর্বে টিউমারের সাইজ কমিয়ে আনার জন্য এবং সার্জারির পর অবশিষ্ট ক্যান্সাস কোষকে ধ্বংস করার জন্য দেওয়া হয়।রোগী যদি সার্জারি করার মত অবস্থায় না থাকে সেক্ষেত্রে সার্জারির বিকল্প হিসেবেও রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়।
৩. কেমোথেরাপিঃ ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য অনেকসময় রেডিও থেরাপি এবং কেমোথেরাপি একসাথে দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ক্যান্সারকে নির্মূল করতে পারলেও অতিরিক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে শরীরে বিরুপ প্রভাব ফেলে।
ইন্টারভেনশনাল কেমোথেরাপিঃ এটি একপ্রকার কেমোথেরাপি যা প্রচলিত কেমোথেরাপি পদ্ধতি থেকে ভিন্ন এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও অনেক কম। এটি সাধারণত মধ্য ও পরিণত পর্যায়ের ক্যান্সার রোগীদের জন্য দেওয়া হয়।
৪. ফটোডায়নামিক ট্রিটমেন্ট ঃ সাম্প্রতিক সময়ে নতুন ফটোসেনসিটাইজার ও এন্ডওস্কোপ টেকনোলজি ফটোডায়নামিক থেরাপিকে আরও উন্নত করেছে এবং প্রথম সারির থেরাপিগুলোর পর এটি সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয়।
৫. টি. সি.এম. থেরাপিঃ বহু বছরের গবেষণায় দেখা গেছে টি.সি.এম. বা ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন মানুষের শরীরকে আরও বলবৎ করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।এছাড়াও এটি অ্যান্টি-ক্যান্সার হিসেবেও কাজ করে। ওয়েস্টার্ন মেডিসিন এর সাথে চাইনিজ মেডিসিন এর ব্যবহার চিকিৎসা কে আরও কার্যকর করে তোলে। এছাড়াও রেডিও থেরাপি এবং কেমোথেরাপির পর শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ দূরীকরণেও এটি সাহায্য করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও বাড়িয়ে দেয় ফলে রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
আমরা কি ধরনের সেবা দিয়ে থাকিঃ
বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যেসব হসপিটাল এ মাল্টিপল ডিসিপ্লিন থাকে যেমন অঙ্কসার্জারি , অঙ্কলজি, প্যাথলজি, ইমেইজলজি ইত্যাদি সহ এনেস্থেশিয়ার ডাক্তার এবং অভিজ্ঞ নার্স থাকে তাদের চিকিৎসা ব্যাবস্থা অত্যন্ত উন্নত, সাশ্রয়ী, উপযুক্ত ও কার্যকর হয়।
মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ এর “ওয়ান স্টপ” মেডিকেল সিস্টেম এ রয়েছে একাধিক মেডিকেল বিভাগের সমন্বয় যা রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন সময় এ রোগ নির্ণয়ের সুবিধা প্রদান করে। এর ফলে ডায়াগনোসিস বা রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীকে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়না। সুতরাং একদিকে এটি যেমন উন্নত ও আন্তরিক সব ধরনের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে তেমনি অন্য দিকে এটি চিকিৎসার কার্যকারিতা ও মান নিশ্চিত করে। ডাক্তারদের সাথে রোগীরা যাতে সহজে যোগাযোগ করতে পারেন সেজন্য এখানে বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে যেমন অনলাইন কন্সালটেশন, ই-মেইল, টেলিফোন কনভারসেশন, ফেইস টু ফেইস বা সরাসরি কন্সালটেশন এর সুবিধা। একজন ক্যান্সার রোগীকে এই ধরনের সেবা বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকে। এখানকার মেডিকেল টিম বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, পুষ্টিবিদ,অনুবাদক প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত যাতে যে কোন দেশের যে কোন পর্যায়ের রোগীকে আন্তরিক সেবা দেয়া সম্ভব হয়। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে ডাক্তার এবং হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনরূপ বাধা না থাকায় রোগীরা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
scrollTop